Meghalaya

মেঘের দেশে

‘গো করোনা, গো’ গেয়ে গেয়ে যখন করোনা মন থেকে প্রায় মুছেই গেলো, তখন আর ঘুরতে যেতেই বা দোষ কিসের? সেই আগের বছরে এপ্রিলে ডুয়ার্স ট্রিপ প্ল্যান করেও সব বুকিং লাস্ট মিনিটে বাতিল করতে হয়েছিলো। তারপর থেকে আর ঘুরতে যাবার কথা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু বছরের শুরু থেকেই সবার প্রোফাইলে ঘুরতে যাবার ছবি দেখে দেখে আস্তে ঘুরতে যাবার ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠছিল। জানতাম, হাতের কাজ শেষ না করে কোথাও যাবার জো নেই। তাই, ঘোরা শুরু হলো অনেকটা ‘সানডে সাসপেন্স’ শোনার মত করে – বন্ধুদের প্ল্যান দিয়ে, ঘোরার গল্প শুনে আর ছবি দেখে। বাচকের মনে ভর করে কল্প-ভ্রমনের এই প্রথম পরিচ্ছেদের খানিকটা লেখা হলো আকাশে আর, বাকিটা নদীর জলে।

বাচক ঘোরা-পাগলা ছেলে! কাজেই, চেনাশোনা কয়েকজন যখন মেঘালয় যাবে শুনলো, সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। যাবার সুযোগ না থাকলেও, প্ল্যানটা করার লোভ সামলাতে পারলাম না আমিও। ঘোরার প্ল্যান করার মধ্যেই আমার অনেকটা ঘোরা হয়ে যায়। বাচকের সাথে বসে বুক করলাম হোটেল, ফ্লাইট আর গাড়ী। এদের হাতে ঘোরার সময় মাত্র সাড়ে তিন দিন। আমার আগেকার বানানো একটা ৬ দিনের প্ল্যান কাটছাঁট করে আর টিপেটুপে যেভাবে নতুন প্ল্যানটাতে ঢোকানো হল, তাতে রানটাইমে যে কি মাত্রায় ইম্প্রভাইজ করতে হবে, সেই ভাবতে ভাবতেই আমার সাড়ে তিন দিন কেটে গেল। তাই, এই সাড়ে তিন দিনের গল্প সরাসরি বাচকের নিজের ডাইরীর নোটের রূপান্তর।

দিন ১:

ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। হাল্কা এক্সাইটেড! প্রথম বার ফ্লাইটে ওঠার থ্রিল, আর কি! ওয়েব চেক-ইন টিন সব আগেই সারা। আর, কি সব রুল-টুল থাকবে সেই ভয়ে একটু আগে আগেই বেরিয়ে পড়লাম। এয়ারপোর্ট চত্বরে পৌঁছে দেখা পেলাম সবার। ডোমেস্টিক বলেই হয়ত, নামমাত্র সিকিউরিটি ড্রিল সামলে উঠে বসলাম প্লেনে। টেক-অফটা সময়মত হওয়াতে একটু নিশ্চিন্ত হলাম; কারণ, আজকে অনেকটা এরিয়া কভার করার প্ল্যান! গুয়াহাটির ফ্লাইট মোটের ওপর ফাঁকাই বলা চলে। জানলার ধারে বসে জীবনের প্রথম ফ্লাইট উপভোগ করলাম তারিয়ে তারিয়ে।

গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে এসে প্লেন ঢুকল প্রায় আট’টার দিকে। কলকাতায় প্লেন ধরার তাড়ায় এদিক ওদিক ভালো করে ঠাওর করে ওঠা হয়নি। সব পুষিয়ে দিয়ে, গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে সেলফি তুলে, দোকান ঘুরে আর স্যুভেনির কিনতে কিনতে কাটিয়ে ফেললাম একটা ঘন্টা। যখন হুঁশ ফিরলো, ততক্ষণে আমাদের লাগেজগুলো কনভেয়ারে হাজার খানেকবার ঘুরে টলতে টলতে গ্যারেজ হয়ে গেছে অন্য একজনের হাতে। সেই ভদ্রলোক নিজের ব্যাগ পায়নি; এই পরিস্থিতিতে অন্তত অন্য কারো ব্যাগও যদি না নিয়ে যেতে পারে, তাহলে বাড়ীতে গেলে বউ-এর কাছে হয়তো বকা খাবে! অল্প ছোটাছুটি করে প্রথমেই উদ্ধার করলাম তাঁর হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ আর তাঁর হাত থেকে আমাদের লাগেজগুলোও।

আমাদের পুরো ট্রিপটার জন্যেই একটা ইনোভা বুক করে রেখেছিলাম আসার আগেই। সবচেয়ে সস্তার ডিল দিয়েছিলো কামাক্ষী ট্রাভেলস : সাড়ে তিন দিনের ট্রিপের জন্যে ১৭,৫০০০ টাকা। ওদের ড্রাইভার হাজির ছিল এয়ারপোর্টে। যাত্রা শুরু হল প্রায় সাড়ে ন’টার দিকে। মেঘালয় ঢোকার মুখে জোগাড় করতে হল ই-পাস। মেঘালয় ট্যুরিজমের একটা অ্যাপ ইনস্টল করে জমা করতে হল অনেক তথ্য : সবার ছবি, আই-কার্ড আর আমাদের প্রত্যেক দিনের ঘোরার আর থাকার জায়গার হদিশ। লাইন দিয়ে এসব সারতে সারতে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল।

Umiam Lake এসে পৌঁছলাম প্রায় বারোটার দিকে। বেশ বড়সড় এই লেকটায় রয়েছে বোটিং এর ব্যবস্থাও। তবে আমরা ফিরলাম ভিউপয়েন্ট থেকেই।

এরপর গেলাম মেঘালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে একটায়, Elephant Falls-এ।

পরের স্পট যাবার পথে, Dongsurok-এর কাছে রাস্তার ধারে বেশ ভিড় চোখে পড়ল। বুঝলাম, স্থানীয় কোন উৎসবের জন্য নাচের আয়োজন। সামান্য স্থানীয় নাচ আর সাজপোশাক পরা ট্যুরিস্টদের ছবি ক্যামেরাবন্দী করে …

… চললাম এগিয়ে। আরেকটা হল্টে লাঞ্চ খেয়ে অল্প ভাতঘুম সারলাম। Garden Of Caves ঢুকলাম বিকেল করে।

সারা দিনের ঘোরার শেষ করে সন্ধ্যে সাত’টায় এসে পৌঁছলাম চেরাপুঞ্জির Five Pearls Homestayতে, আজকের মাথা গোঁজার আস্তানায়। এই হোমস্টেতে দুটো রুম বুক করে রেখেছিলাম Booking.com থেকে।

কাল প্রথমেই যাবার কথা Double Decker Living Root Bridge, যেটা ঘোরার জন্যে সময় রেখেছিলাম আধ ঘণ্টা। কিন্তু, এখানকার লোকজনদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, সেটা প্রায় ঘণ্টা পাঁচেকের হাঁটার ব্যাপার। খুব ভোর-রাতে বেরিয়ে পড়তে পারলে সেটা সামাল দেওয়া যাবে, এই আশায় ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়িই। তবে, বাকিরা উঠতে পারবে বলে আমার মনে হলনা।

দিন ২:

আমাকে খুবই অবাক করে দিয়ে, সবাই রেডি হয়ে গেছে রাত তিনটের মধ্যে। কারও উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা নেই। আমি খানিকটা ঘুম গাড়ীতেই সারব ভেবে বেরিয়ে পড়লাম। Living Root Bridge দেখার জন্য Nongriat এসে ঢুকলাম ৭টার দিকে। গাড়ী থেকে নেমে বড় করে একটা হাই তুলছিলাম; সামনের থরেথরে নেমে যাওয়া সিঁড়ি দেখেই সেটা উড়ে গেল। মোট তিন হাজার সিঁড়ি – বেশী হলেও অবাক হবোনা! কাজেই, বেশী না ভেবে নামা শুরু করে দিলাম।

দুশোর মত সিঁড়ি নামার পর পেলাম একটা ভিউপয়েন্ট।

পাঁচশো সিঁড়ি নামতেই দম প্রায় শেষ হয়ে গেল। বাকিটা হারিয়ে ফেললাম ওপরে ওঠার সময় কি হবে সেই ভেবে। বাকিদের অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। আর, তার চেয়েও খারাপ হাল সিঁড়ি-গুলোর।

ধাপগুলো যা চওড়া, তাতে পুরো পা আঁটে না; কোথাও কোথাও একদিকে খাদ আর রেলিংটাও অঞ্জনদা দার্জিলিং-এ লাগিয়ে বসে আছেন! এই অবস্থায় পুরোটা যেতে চাইলে, আজকে আর ডাউকী গিয়ে পৌছনোর আশা নেই। একমত হতে বেশী সময় লাগলো না। ফেরা শুরু করলাম।

ক্লান্তি আর হতাশা কাটিয়ে আমাদের গাড়ী এগিয়ে চলল। এক ঘন্টা পরে এসে পৌঁছলাম Dainthlen Falls।-এর কাছে। বৃষ্টির অভাবে জলের তেমন বেগ নেই; তবু চারপাশের পাথর চিরে বেয়ে পড়ছে অবলীলায়।

এরপর মাথাপিছু ৫০ টাকা এন্ট্রিফি আর পার্কিং-এর ৩০ টাকা জমা করে ঢুকলাম Arwah Lumshynna Cave-এ।

Mawkdok Dympep Valley Viewpoint পেলাম আমাদের পথের মাঝেই।

এর পরের স্পট Nohkalikai Falls Viewpoint, মেঘালায়ের সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত।

দুপুরের খাবার হজম করতে Mawsmai Caveটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল।

আরেকটু বেশি খেয়ে নিলে ওখানকার গুহাগুলোতে ঢোকা-বেরোনোয় সমস্যা হয়ে যেতো!

প্রথম গেটে জমা করলাম মাথাপিছু ৩০ টাকা এন্ট্রিফি আর পার্কিং-এর ২০ টাকা। দ্বিতীয় গেটেও আবার সেই মাথাপিছু ৩০ টাকা এন্ট্রিফি আর পার্কিং-এর ৫০ টাকা। একই স্পটের দুই গেটেই ফি জমা দেবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।

সাত বোনের বাকিদের দেখা পেলাম না; সদ্য শীত কাটিয়ে Seven Sisters Falls এর তখন একটাই ধারা।

জল তেমন নেই জেনে প্ল্যান থেকে কাটিয়ে দিয়েছিলাম Rainbow Falls আর Lyngksiar Falls; সে জায়গায় হাজিরা দিলো Wah-Kaba Falls. মাথাপিছু ১২ টাকা এন্ট্রিফি আর পার্কিং-এর ২০ টাকা জমা করে এলাম ফলসের একেবারে মাথায়।

আজকের মত ঘোরা শেষ। তবে রাতের ঠিকানা পৌঁছতে লাগবে এখনও তিন ঘন্টার কাছাকাছি। শিলং পেরবার পর হঠাৎই মেঘ এসে ঘিরে ধরলো আমাদের। হুট করে আবহাওয়াতে মিশে গেল ঠান্ডার আমেজ; চলার পথ হয়ে এল আবছা।

ডাউকী পেরিয়ে Darrang গ্রামে ঢোকার জন্যে ২৫০ টাকা জমা দিতে হল, পাশের নদীতট রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ। এই গ্রামেরই Halatong Homestayতে ফোন করেই বুক করে রেখেছিলাম দুটো রুম। তবে রুমগুলো যথেষ্ট বড় দেখে, ঠিক করলাম একটা রুমেই সবাই থাকব্।

দিন ৩:

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বাকিরা রেডি হতে হতে, আমি একবার ঢুঁ মারলাম পাশের ব্রিজে।

লোহার সরু ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে Umngot নদীর পরিস্কার জলের রোজনামচা মিলিয়ে নিলাম।

ব্রেকফাস্ট সেরে এসে পৌঁছলাম Dawki Boating Point-এ। বোটপিছু ভাড়া লাগলো ৮০০ টাকা; এক একটা বোটে লোক ধরবে ৩ জন।

চেরাপুঞ্জির Double Decker Living Root Bridge দেখতে না পারার দুঃখ ভোলার জন্যে এরপর আমরা চললাম Mawlynnong এর Living Root Bridge-এর দিকে।

এশিয়ার সবচেয়ে পরিস্কার গ্রাম Mawlynnong এসে ঢুকলাম। রাস্তায় দলপিছু জমা করতে হল ২০০ টাকা, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ। তবে, আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হল, গ্রামটা ততটাই সাফসুতরো, যতটা কৃত্রিম।

বাড়তি হিসেবে পাওনা পেলাম একটা Tree House, যেটার নাম Skyview Bangladesh Viewpoint

… আর গ্রামের চার্চ : Church of The Epiphany

এবার ফেরার পালা। শিলং যাবার পথে দেখে নিলাম Mawjngih Lapynshongdor Viewpoint

শিলং এসে ঢুকলাম প্রায় ৭টার দিকে। একটা বড় কাজ বাকি ছিল – হোটেল খোঁজা। পুলিশবাজারে এসে আমি হোটেল খুঁজতে থাকলাম; বাকিরা মন দিল কেনাকাটায়। সকাল সকাল ফ্লাইট ধরতে হবে গুয়াহাটি থেকে; সামান্য ক’টা ঘন্টার জন্য বেশী খরচা না বাড়িয়ে Hotel Shaurya Inn এ একটা বড় রুম বুক করলাম। ডিনার সেরে ঘুমোতে যাব বলে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলাম সিনেমা দেখে!

দিন ৪:

আমাদের ড্রাইভার রাস্তায় জ্যামের ভয় দেখিয়ে রেখেছিলো আগে থেকেই। তাই, আমরাও ওর কথামত রাত তিনটের সময় গাড়ীতে উঠে বসলাম ঘুম চোখে নিয়েই। গাড়ীতে উঠেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম সব্বাই। রাস্তায় কোনও জ্যাম ছিলনা, তাই এয়ারপোর্টে ঢুকেও গেলাম সকাল ৬টায়। পরে যা বুঝলাম, ড্রাইভারের আরও কোন বুকিং ছিল। তাই, সে দেরী না করে আমাদের সকাল সকাল গুয়াহাটি পৌঁছেছে। তাতে আমাদের তেমন আপত্তি না থাকলেও, যেটা মেনে নিতে পারলাম না সেটা হল – ৩ ঘণ্টার জন্য সারা দিনের ভাড়া গোনা। ঘুমের দ্বিতীয় পালা চলল এয়ারপোর্টেই। প্লেন আসতে ঘুম কাটিয়ে উঠে লাইন দিলাম। সিকিউরিটি চেকিং-এ আমার স্যানিটাইজার আর ডিওটা জমা পড়ে গেল! প্লেন ছাড়লো কাঁটায় কাঁটায় ১১টায়। এখন বেলা প্রায় বারোটা; জানলা দিয়ে আমার প্রিয় শহরের জল-মাটি দেখা যাচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :

হোটেল :

  • চেরাপুঞ্জি : Five Pearls Homestay [২ টো রুমের ভাড়া ৩৫০০ টাকা ; মোবাইল : ৯৮৩২০ ৯৮৩২০]
  • ডাউকি : Halatong Homestay [১ টা রুমের ভাড়া ১৫০০ টাকা ; মোবাইল : ৯৮৩২০ ৯৮৩২০]
  • শিলং : Hotel Shaurya Inn [১ টো রুমের ভাড়া ২৫০০ টাকা ; মোবাইল : ৯০৮৯০ ৬২৩৪৫ ]

গাড়ী :

  • Kamakshi Tours [ মোবাইল : ৯৮৬৪০ ৪৭৯৯৬, ৯৮৬৪০ ৭৬৭৪৯ ]
  • Jyoti Travels [ মোবাইল : ৮৬৩৮০ ২৯১৯২ ]
  • Assam Cabs [ মোবাইল : ৯৪০১৩ ৮৮৬৩০, ৮৭২০৯ ২৭৫৫১ ]