হঠাত একদিন, লেপাক্ষী : পর্ব ১

১৯১০ সাল| হ্যামিল্টন সাহেব ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন| লন্ডনের নাম করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তিনি| পুরোনো সব গথিক আর রোমান স্থাপত্য এবং তাদের স্ট্রাকচার নিয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান| এখন ইন্ডিয়াতে এসেছেন এদেশের পুরনো মন্দির-টন্দির নিয়ে কাজ করতে| আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে| এদেশে এসে দেখলেন, নেটিভরা বহু কোটি মন্দির বানিয়ে রেখেছে সারা দেশ জুড়ে| সেসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করে যেতে হচ্ছে| রেনেসাঁরও অনেক আগে এদেশে লোকজন বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর মন্দির তৈরী করে গেছে| মাঝে মাঝে অবাক-ও লাগে তাঁর| তা কিছুদিন হলো, দিব্য দক্ষিন ভারতের ব্যাঙ্গালোর নামের ছোট্ট হিল-স্টেশনে সামারটা কাটাচ্ছিলেন, বাদ সাধলেন এএসএই-এর ডিরেক্টর| তাই তাঁকে ছুটতে হচ্ছে দেড়শ কিলোমিটার দুরে কোন এক ধ্যাড়ধেড়ে অনন্তপুরম গ্রামে| সেখানে নাকি একটা মন্দির ভেঙে পড়বে পড়বে করছে| এত্তো মন্দির, একটা ভাঙ্গলেই বা কি? যাই হোক, অর্ডার ইজ অর্ডার| সোলার হ্যাট চাপিয়ে চললেন সাহেব| মন্দির সারাতে| অনেক দুরের পথ| সঙ্গে তাঁর আসিস্টান্ট আর সাঙ্গপাঙ্গরাও চলেছে|

২০১৭ সাল| ছোটবেলায় ভাবতাম রাজা-উজির হব| আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে জীবনটা এখন বোড়ে হয়ে গেছে| তাই নিজেকে রিফ্রেশ করার জন্য শনিবার লং-ড্রাইভে যাবার প্ল্যান| আমি ছাড়াও আরো তিনজন উল্লসিত অবোধ চাকুরিজীবি| প্রীতম (ডাকনাম মামা), আমার হাগিস-পরা বয়েসের বন্ধু, তার স্ত্রী দেবলিকা (ট্রানসিটিভ প্রপার্টির হিসেবে ইনি হলেন মামী) এবং আমার এক জুনিয়র ইউপা (পিতৃমাতৃদত্ত নাম, যার মানে ‘ইউএর মতো পা=মনুষ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস’) | আমার গিন্নি শনিবারেও ল্যাবে যান| শুয়োরকে ইনজেকশন দিতে| বৈজ্ঞানিক মানুষ, কিসব অষুধ-টসুধ বানিয়ে শুয়োরের ওপর পরীক্ষা করেন| মাঝেমধ্যে বলি, “কটা শুয়োর ধরে আনো না একদিন, গুছিয়ে পর্ক-স্টেক খাব”| তা শুনে আমার দিকে এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকান, মনে হয় আমি ওনার শুয়োরগুলো খেয়ে নিলে ওই ইনজেকশনগুলো আমাকেই দেওয়া হবে| যাক, এসব লং ড্রাইভ-টাইভ ওনার এবং ওনার জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শুয়োরদের জন্য নয়| কাজেই আমি পত্নী-বিহীন স্বাধীন পথের পথিক (মানে ড্রাইভার) আজ| সকালে দশটার সময় বেরুনোর কথা| কোথায় যাবো কেউ জানে না| মোটামুটি যেদিকে দুচোখ যায় গাড়ি ছোটাব| এত সাংঘাতিক প্ল্যান যখন, সকালে উঠতে হবে| স্বাভাবিকভাবেই সকালবেলা চোখ খুলে মনে হলো আরেকটু ঘুমনোই যায়| এই ভাবে একটা ইনফাইনাইট লুপ তৈরী হতে হতে বেলা এগারোটায় ব্রেক স্টেটমেন্ট পেলাম| প্রীতম কলিংবেল বাজাতে| বড়সড় ম্যানেজার মানুষ| ভয়ে ভয়ে দরজা খুলেই তৈরী হতে শুরু করে দিলাম, নয়তো বকে দিতে পারে| ইউপাও হাজির| আমি রুটি আর বাঁধাকপির তরকারী খেয়ে রেডি| হঠাত মনে পড়ল, একটা মন্দিরের কথা শুনেছিলাম, দেড়শ কিলোমিটার দুরে, অন্ধ্রপ্রদেশ বর্ডার পেরিয়ে| রাস্তাটা সুন্দর| ওদেরকে বলতে ওরাও বললো “চল তবে দেখে আসি”| ঠিক হলো, প্রীতমের ঝাঁ-চকচকে ব্যালানো গাড়িটা নিয়েই যাওয়া হবে| চারজন যখন একটা গাড়িতেই এঁটে যাবো| সাজুগুজু করে চোখে সানগ্লাস পরে আমি প্রীতমকে হটিয়ে দিয়ে নিজেই স্টিয়ারিং-এ বসলুম|

১৫২৬ সাল| ১৪৫০ শকাব্দ| বিজয়নগর সাম্রাজ্য তখন গোটা দক্ষিন ভারতে হিন্দুদের কাছে নতুন আশা-ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে|মধ্যযুগ| দিল্লীতে ইব্রাহিম লোধি| গোটা ভারতবর্ষকে মুসলিমরা কব্জা করেছে| শান্তির বাণী ইসলাম| কিন্তু হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে তখন বেশ অশান্তিই চলছিল| হিন্দুরাও আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে নিজেদের ধর্ম আর সংস্কৃতিকে যবনের হাত থেকে বাঁচানোর| এইসব গন্ডগোলের মধ্যেই ভারতীয়রা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ব্যাপারটা বুঝতে শিখছিল আস্তে আস্তে | এই একই সময়ে, আমাদের বাংলাদেশে চৈতন্য মহাপ্রভু উদ্বাহু হয়ে নেচে বেড়াচ্ছেন গৌড়বঙ্গ থেকে উড়িষ্যা| মানুষকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন| কিন্তু আমরা যত কষ্টে, যত রক্তে কিছু শিখি, সেটা ভুলতে খুব বেশি কষ্ট করি না| তাই আবার নতুন রক্ত দিয়ে সেটা শিখতে হয়| যেমন ধরুন…. না থাক, ওরা আবার এন্টিন্যাশনাল বলবে! যাই হোক, যা বলছিলাম| যদিও শাসকের ধর্ম নেই, তারা তবুও বেহেস্তে যাবার আশায় এদেশে শাসন করছে| লুঠপাঠ করছে তার থেকে বেশি| মুঘলরা তখনো ভারতে আসে নি| সম্রাট বাবর তখন আফগানিস্তানে পাথর ভেঙে, বরফ কেটে, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে দিল্লী আসার চেষ্টা করছেন| মুসলিম সুলতানরা গোটা দেশে শাসন করলেও, কর্ণাটকের কাছে বিজাপুর পেরোলেই তাঁদের দৌড় শেষ হয়ে যেত| কোনভাবেই তুঙ্গভদ্রা নদী পেরোতে পারেনি তারা| তুঙ্গভদ্রার তীরেই বিজয়নগর সাম্যাজ্য| দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছেন রাজা কৃষ্ণদেব রাও| মুসলিম শাসনে অত্যাচারিত হয়ে নানা জায়গা থেকে হিন্দুরা এসে আশ্রয় নিচ্ছে বিজয়্নগরে এসে| সারা সাম্রাজ্য জুড়ে তৈরী হচ্ছে অসংখ্য মন্দির| রাজা কৃষ্ণদেব রাওয়ের সভাসদ দুই ভাই, বিরুপান্ন আর বিরন্ন| এরা পেনুকন্ডা নাম একটা অঙ্গরাজ্যের শাসক| বিরুপান্ন ছিলেন রাজা কৃষ্ণদেবের প্রধান কোষাধ্যক্ষ| পেনুকন্ডা রাজ্যের মধ্যে অনন্তপুরম গ্রাম| পৌরানিক যুগে অগস্ত্যমুনির আশ্রম ছিল এখানে| স্কন্দপুরানেও উল্লেখ আছে| শিবের দিব্যক্ষেত্র এখানে| এখানেই শিবের ক্রোধ থেকে জন্ম নিয়েছিল আরেক দেবতা বীরভদ্র| বিরুপান্ন আর বিরন্নর বড় ইচ্ছে এখানে একখান মন্দির বানাবেন| বীরভদ্রের মন্দির| সে মন্দিরের খ্যাতি দূর দুরান্তে ছড়িয়ে যাবে| শুধু দরকার অর্থবল| রাজা কৃষ্ণদেবকে বলেওছেন তাঁরা| কৃষ্ণদেবের সম্মতির অপেক্ষা শুধু| কিন্তু বিধি বাম| কৃষ্ণদেব দেহ রাখলেন| নতুন রাজা হলেন অচ্যুতদেব রাও| আবার দুই ভাই অচ্যুতদেবকে পেশ করলেন নিজেদের বাসনা| অচ্যুতদেব নিজেও হিন্দুদের রক্ষাকর্তা| তা মন্দির বানাতে তাঁর সম্মতি পাওয়া গেলো| লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন| বলে দিলেন, কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে বানাও তোমাদের মন্দির| দুই ভাই উত্সাহের সঙ্গে শুরু করে দিলেন মন্দির বানানোর কাজ| দেশ জুড়ে শ্রেষ্ট স্থপতিদের আনা হলো| শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের ডাকা হলো| হই হই কান্ড তখন অনন্ত্পুরম গ্রামে| দুই ভাই ফিরে এলেন রাজধানী থেকে দুরে, পেনুকন্ডাতে| সেখানে একটি দুর্গ ছিল| সেই দুর্গেই থাকতেন দুই ভাই| এখান থেকে তিরিশ ক্রোশ দুরে শুরু হয় মহীশূর রাজ্যের সীমানা| কিছুদিন আগেই সেখানকার রাজারা অনন্তদেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন| মহীশূর রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে অনেক দুর্গ তৈরী হয়েছে| ওই গ্রামগুলোকে বলা হয় “বেঙ্গাওয়াল-উরু” বা প্রহরীদের গ্রাম| প্রহরীদের এক নেতা কেম্পে গৌড়ার সাহসিকতা আর বীরত্বের খবর সারা বিজয়নগর আর বিজাপুরের মানুষের জানা| এমন দুর্দিনে বিরুপান্ন বা বীরন্নর বেঙ্গাওয়াল-উরুর কাছে গিয়ে থাকাটা রাজা মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না| তাছাড়া রাজনীতি বড় কঠিন ঠাই| বিরুপান্ন আর বিরন্নোর বিরুদ্ধে রাজার কান ভারী করার লোকের অভাব হলো না| দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়| রাজকোষ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকাও যায়| এভাবে বেশ একটা দশক পেরোতে থাকে| অচ্যুত্দেব পরাক্রমী রাজা| বিজাপুরের সুলতানদের ক্ষমতা হয় না বিজয়নগর জয় করে মুসলিম রাজ্য বানাবে| এদিকে অন্য সভাসদরা রাজাকে বলে, মন্দিরের হলটা কি? রাজাও জিগেস করেন| বিরুপান্ন বলেন “এই তো মহারাজ হলো বলে, সবই তৈরী| শুধু কল্যানমন্তপের কাজটুকুই যা বাকি”| কিন্তু রাজার কাছে খবর আসে, এত টাকা খরচ করে বানানো হয়েছে একটা ভাঙ্গাচোরা মন্দির| তার থামগুলো সোজা করেও বানাতে পারে নি স্থপতি| তাতে আবার নানা নক্সা কাটা| তার ওপর ছাদে কোনো কারুকাজ নেই| চিত্রকর ডেকে নাকি শুধু কিছু ছবি আঁকানো হয়েছে| এসব শুনে রাজা একদিন বলেন “হিসেব দেখি কোষাগারের”| হিসেব দেখে রাজার চক্ষু চড়কগাছ| বলেন “তবে রে… এত টাকা খরচা করে ভাঙ্গা মন্দির! দে ব্যাটা বিরুপান্নর চোখ দুটো গেলে”| খবর পৌছায় অনন্তপুরমে| বেচারা বিরুপান্ন| ঠিক করে বোঝাতে পারেন না মন্দির বানাতে এত খরচ কেন হয়েছে| কিন্তু তিনি জানেন একটা তাম্রমুদ্রাও বাজে খরচ করেন নি তিনি| এই কয়েক বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন মন্দির| রাজা তাঁর প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন| কিন্তু তিনি নিজে জানেন আনুগত্য তাঁর শিরায় শিরায়| মনের দুঃখে ছুটে যান মন্দিরের কল্যাণমন্তপে| নিজেই নিজের চোখ দুটো উপড়ে ছুড়ে ফেলেন দেওয়ালে| সেই ভাঙাচোরা মন্দির পাঁচখানা শতাব্দী পার করে আজও দাঁড়িয়ে আছে| দেওয়ালে এখনো রক্তের দাগ দেখা যায়| শুধু সেই নির্মীয়মান কল্যানমন্তপখানি আজও তৈরী হয় নি| বাকি মন্দির কিন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে|

২০১৭ সাল| আমরা ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলেছি| আজকাল ভারতে এত ভালো রাস্তা তৈরী হয়েছে, সত্যি অবাক লাগে| মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কোথায় গাড়ি চালাচ্ছি, ভারতে না বিদেশে? দেশের এই উন্নতিতে খুশি হয়ে এক্সিলেটরে চাপ দিলাম| নতুন গাড়ি| হই হই করে ছুটে চলেছে সিক্স-লেন রাস্তা ধরে| মাঝে ডিভাইডার| উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসার সম্ভাবনা নেই| আমি চলেছি, একদম ডান দিকের লেন ধরে| আমেরিকাতে যেটাকে বলে আল্ট্রা-ফাস্ট লেন (ওদের অবশ্য বাঁ-দিকে)| হঠাত দেখি উল্টো দিক থেকে এক বয়স্ক লোক মোপেড নিয়ে দাপটের সঙ্গে ওই বীরদর্পে এগিয়ে আসছেন| আমার সেই আল্ট্রা-ফাস্ট লেন দিয়ে, বেশ অনাবিল মুখে, জীবনে কোনো তাড়া নেই এমন ভাব করে| ছোটবেলায় শেখানো হয়েছিল, রাস্তার বাঁ-দিক দিয়ে যেতে| উনি সেটাই করে চলেছেন| তফাত, শুধু উল্টো দিকের লেন দিয়ে করছেন| সাবাস ভারতবর্ষ! রাস্তাঘাট হোক না বিদেশের মতো, মানুষগুলো যে আমার-ই দেশবাসী! আমার বিষয়টা বিশ্বাস করতে কিছুটা সময় লেগেছিল| তারপর ব্রেকে পা দিয়ে গাড়িটাকে দ্রুত পাশের লেনে নিয়ে গেলাম| এবং বিস্ময়ভরা চোখে জানলা দিয়ে ফিরে ভদ্রলোককে দেখলাম| উনি বেশ “তোমরা আজকালকার ছেলেরা কি যে গাড়ি চালাও!” ধরনের হাবভাব নেওয়া মুখে তাকিয়ে দিলেন| ওনার সৌভাগ্য এবং ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য যে আমার পাশের লেনে অন্য কোনো গাড়ি ছিলো না| যতদুর বুঝলাম, আর বেশিক্ষণ নেই| আমার পেছনে আরো গাড়ি আসছে, যাদেরকে আমি একটু আগেই ওভারটেক করে এসেছি| তারাই ভদ্রলোকের দায়িত্ব বুঝে নেবে| ভদ্রলোক দেখলাম বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ না করে ভুল লেন ধরে বৈকুন্ঠের পথে এগিয়ে গেলেন| হিউম্যান জিনপুল থেকে যত দ্রুত এনার জিনটা সরে যাবে ততই মঙ্গল মানবজাতির জন্য| আমি আর প্রীতম যখন এই অকালকুষ্মান্ড মোপেড-দাদুর উদ্দেশে গালাগালির তুবড়ি ছোটাচ্চি, দেবলিকা পেছনের সীট থেকে গম্ভীর গলায় বললো “এইরকম লোকের হাত পা বেঁধে নাকে আর কানে সুড়সুড়ি দেওয়া উচিত”| সব রাগ ভুলে গাড়ির ভেতরে চারজনেই হেসে উঠলাম| মামী ইজ মামী, ওয়ান এন্ড অনলি| মনে মনে ব্যাপারটা কল্পনা করে নিলাম| একটা লোকের হাত পা বেঁধে নাকে আর কানে সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে| হাসতে হাসতেই স্টীয়ারিং হাতে উপলব্ধি করলাম, মেয়েরা নিষ্ঠুরতায় হিটলারকে হার মানাতে পারে| আমাদের সামনের রাস্তা মসৃণ| পাহাড় ঘেরা রাস্তা| পাহাড়ের নানা রকম রং এখানে| আর দিগন্তছুঁয়ে সবুজ আর নীল মিলেমিশে গেছে| বৃষ্টির পরে এইসব দিকে কত রকম সবুজের শেড দেখা যায় যে বলার নয়| মেঘ, আকাশ, পাহাড়, রাস্তা আর মাঝে মাঝে কৃষ্ণচুড়ার লাল — সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর ছবি| ছোটবেলায় ড্রয়িং খাতায় এইরকম ছবি-ই আঁকতাম| এখনো এরম অসাধারণ রঙিন প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যেতে যেতে মনে হয় যেন কোনো এক অজানা বিশাল শিশু নিজের ড্রয়িং খাতায় আনমনে প্যাস্টেল দিয়ে রং করে চলেছে| সেই ড্রয়িংখাতায় আঁকা সিনারির মধ্যে আমি, আমার বন্ধুরা, এই খয়েরি রঙের গাড়ি সব যেন এক একটা চরিত্র| এইসব দার্শনিক চিন্তা মনের মধ্যে ভিড় করে আসার অনেক আগেই আমি আর প্রীতম সিত বদলে নিয়েছি| প্রীতম স্টিয়ারিংএ বসেছে| আমি গুগুল ম্যাপ খুলে ওকে রাস্তা বলে দেবার দায়িত্ব নিয়েছি| কিন্তু আমার মোবাইলের সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি হাই-ডেফিনিশন ওএলইডি স্ক্রীনের বাইরে গোটা জগৎ জুড়ে 3D পর্দায় যে সুপার-ডুপার-আল্ট্রা-হাই রেসলিউশনে ওয়ালপেপার আঁকা হয়ে চলেছে, সেখানে পরম-ব্রহ্মসম গুগুল বড়ই তুচ্ছ| হঠাত গাড়ি চালাতে চালাতে মামা, ম্যানেজারসুলভ বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে বললো “ওরে ওই মর্কট, ম্যাপটা দেখছিস? আমাদের একটা লেফট টার্ন নিতে হবে কোথাও”| মর্কট সম্বিত ফিরে পেয়ে মোবাইলে দেখে বললো “এই সামনের লেফটটা নিয়ে নে”| বাক্য শেষ হতে না হতেই বাঁ-দিকে সাদা পাথরের তোরণ দেওয়া রাস্তা দেখা গেলো| অসাধারণ কারুকার্য তাতে| তোরণের ওপরে একটা বড় পাখীর মূর্তি| পাখিটি ডানা মেলে ওড়ার জন্য পোজ নিয়ে বসে| প্রীতম বাঁ-দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে তোরণ দেওয়া পথের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকলো| পেছন থেকে ইউপা বলে উঠলো “বাহ কি সুন্দর প্যাঁচার মূর্তি”| মামী তাতে সহমত জানিয়ে বললো “হ্যা রে.. দারুন ছিল.. ওটা মনে হয় লক্ষীপ্যাঁচা”| প্রীতম বললো “ইইয়ার্কি নাকি, ওটা প্যাঁচা ছিল?ঈগলের মতো দেখতে”| পেছনে বসা দুই নারী একবাক্যে স্বীকার করে নিল ওরা নাকি ঈগল বলতে গিয়ে প্যাঁচা বলেছে| মামী মনে হয় লক্ষী ঈগলের কথা বলছিল| হবেও বা| আমি ভাবলাম চুপ করে বসে থাকা উচিত নয়| তাই আমি আমার জ্ঞানভান্ডার উজাড় করে ফান্ডা দিলাম “ইগল নয়, ওটা আসলে গরুড়, বিষ্ণুর বাহন”| বাকিরা কেউ গরুড়পক্ষী দেখে নি| কাজেই সবাই মেনে নিল ওটা গরুড় ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না| আমার অপরিসীম বৈদগ্ধ্য এই তিনজনের সামনে প্রতিষ্ঠিত হলো|

পুরাকাল| ত্রেতা যুগ| সাল জানি না| রাবণ সীতাদেবীকে কিডন্যাপ করে পুষ্পকরথে করে শ্রীলংকার দিকে চলেছেন| অরুণপুত্র জটায়ু, তা দেখতে পায়| জটায়ুর কাকা ছিলেন গরুড়| জটায়ুর দাদা সম্পাতি ছিলেন দশরথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু| কাজেই তিনি রাম, লক্ষণ বা সীতাকে বিলক্ষণ চেনেন| সীতাকে উদ্ধার করতে উড়ে যায় পুষ্পক রথের দিকে| দশাননের সঙ্গে অনিবার্য যুদ্ধ| সেই বীরত্বের কাহিনী রামায়নে লেখা আছে| রাবনের খড়গের আঘাতে জটায়ুর ডানা কাটা গিয়েছিল| বেচারা ভাঙ্গা ডানার আহত পাখি এসে পড়ল মাটিতে| পরে রাম আর লক্ষণ যখন সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে আহত জটায়ুকে দেখতে পান| জটায়ুর কাছ থেকেই তাঁরা সীতার হদিস জানতে পারেন| এর পরে রাম জটায়ুকে বলেছিলেন, “লে পক্ষী”| এর মানে নাকি “ওঠো পাখি”| তাই থেকে এই জায়গাটার নাম হয় লেপাক্ষী| লে হালুয়া…. ভাগ্যিস রামচন্দ্র আর কিছু বলেন নি|

২০১৭ সাল| সেই প্রহরীদের গ্রাম, বেঙ্গাওয়াল-উরুকে আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের ভিড়ে আজ আর চেনা যায় না| প্রহরীদের নেতা কেম্পে গৌড়ার নাম আজও শোনা যায়| রানওয়েকে স্পর্শ করার পর বিমানের ভেতরে ঘোষণা করা হয় “ইউ আর ওয়েলকাম টু বেঙ্গালুরু কেম্পেগৌডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট”| আপাতত আমরা চলেছি বীরভদ্রেশ্বর মন্দিরের দিকে| জায়গাটা অন্ধ্রপ্রদেশে, জেলা অনন্ত্পুরম, গ্রাম লেপাক্ষী| কাছেই বড় শহর হলো পেনুকন্ডা, এখান থেকেই আমরা জাতীয় সড়ক ছেড়ে বাঁক নিয়েছি| রাস্তার তোরণের ওপরে পাখির মূর্তিটি জটায়ুর| হ্যামিল্টন সাহেবও চলেছেন একই জায়গায়, যদিও সময়টা অন্য, ১৯১০ সাল| বিরুপান্নর বানানো সেই বিখ্যাত মন্দিরে আমাদের সকলের জন্যই চমক অপেক্ষা করে রয়েছে| সেই মন্দিরের স্থাপত্য এমন এক রহস্য যা আজও সমাধান করা যায়নি| সেই গল্প পরবর্তী পর্বে…