Simlipal

বছর দুই আগে সিমলিপালের সবুজে ঘেরা পরিবেশ আর আশেপাশের জায়গাগুলোর কথা বেশকয়েকটা ব্লগে পড়তে পড়তে ঠিকই করে ফেলেছিলাম – “এখনই হোক বা পরে, সিমলিপালটা একবার ঘুরে আসতে হবে”। তারপর থেকে অনেকবার কথা উঠেছে সিমলিপাল যাবার। কিন্তু এদিক ওদিক করে আর ব্যাপারটা হয়ে ওঠেনি – কখনও কাজের চাপে, কখনওবা যথেষ্ট লোক পাওয়া যায়নি বলে। একবার তো সব ঠিক করেও পছন্দসই হোটেল পাইনি বলে প্ল্যান বাতিল হয়ে গেছিল। ২০১৭র ডিসেম্বরে যে সিমলিপাল ট্রিপ প্রথমবারের জন্যে প্ল্যান করেছিলাম, শেষ অবধি সেই ট্রিপ হল ২০১৯র মার্চে। দুঃখের কথা এই যে, সিমলিপাল যাবে বলে তখন যারা বেশি লাফিয়েছিলো তাদের অনেকেই এই ট্রিপে যেতে পারেনি। তবে পাওনা হয়েছিলো কিছু নতুন মুখ। সব মিলিয়ে ৭ জন।

রাস্তার নিরিখে খুব দূর না হলেও খড়্গপুর থেকে সিমলিপাল যাবার ট্রেনের সংখ্যা খুবই কম। তাই, তাজপুর ট্রিপের মত এবারও আমরা স্থানীয় ওমকার ট্রাভেলস থেকে একটা স্করপিও (যোগাযোগ: ৯৪৩৪২ ৪৩৪৯২) বুক করে নিয়েছিলাম। তাছাড়া নিজেদের একটা গাড়ি থাকলে মাঝপথের বেশ কিছু স্পটও ঘুরে নেবার সুবিধে তো থাকেই। জশিপুরে হোটেলের সংখ্যা তারই মধ্যে কিছুটা কম বলে সাইরাম হলিডে হোমে (যোগাযোগ: ৯৯৩৭৮ ২৩০১৪) একটা ছ-বেডের ডর্মিটরি বুকও করে রেখেছিলাম। ড্রাইভার নিয়ে যদিও আমরা ৮ জন, কিন্তু আট-বেডের ডর্মিটরি কোথাও পাইনি বলে ঐ ছ-বেডেই ম্যানেজ করে নেবার প্ল্যান ছিলো।

১ম দিন:

প্ল্যানমত সকাল ৬টায় বেরোবার কথা। সেইমত ভোরভোর উঠে চানটান সেরে রেডি হয়ে বসেই ছিলাম, বাকিরাও তাই। কিন্তু গাড়ি এসে ঢুকলো আধঘন্টা দেরিতে। যাই হোক, অযথা দেরি না করে যাত্রা শুরুর অফিসিয়াল সেলফিটা তুলে রওনা হলাম চটজলদি।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_1

গোপীবল্লভপুরের দিকের রাস্তা খারাপ বলে কেশিয়াড়ী দিয়ে যাবার কথা। সেইমত ঘন্টাখানেক চলার পর ভসরাঘাটের কিছুটা আগে আমরা ব্রেকফাস্টের জন্যে দাঁড়ালাম। যদিও মনটা ইডলি-ইডলি করছিলো (অথচ হোস্টেলে যেদিন ইডলি হয় আমি বাইরে ব্রেড-বাটার খেয়ে নিই), তবু কালেচক্রে খেলাম – মুড়ি, ছোলা ভেজানো আর বেগুনি। যদি আবার খিদে পায় আর তখন কাছেপিঠে দোকান না থাকে, সেই ভয়ে কিনে নিলাম এক ডজন কলাও।

তারপর কেশিয়াড়ী, নয়াগ্রাম পেরিয়ে আরও ঘন্টাখানেক যাবার পর আমরা ঢুকলাম উড়িষ্যায়। এই জায়গাটায় খাটিয়া বানাতে যে দড়ি ব্যবহার করা হয়, সেই দড়ি বানাতে দেখলাম বেশকিছু লোকজনকে রাস্তায় সার দিয়ে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_2

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_3

চারপাশের লোকজন আর প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে সাড়ে তিনঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বারিপদা। সেখান থেকে ডানদিক নিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে চললাম আমাদের প্রথম গন্তব্যে – কুলিয়ানা ডোকলা

কুলিয়ানা গ্রাম বিখ্যাত এদের পিতলের কাজের জন্য। আর, ডোকলা বলা হয় সেইসব গ্রামগুলোকে যেখানে বংশ পরম্পরায় চলে আসা একটা প্রাচীন রীতিতে (এই রীতিরও নাম ডোকলা) পিতল দিয়ে হাতেই বানানো হয় দেবদেবীর মূর্তি। আমাদের বেশি বেগ পেতে হলনা গ্রামটা খুঁজে বের করতে। গ্রামের শুরুরই একটা বাড়িতে ঢুঁ মারলাম।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_4

বাড়ির সামনে বসেই ছাঁচ তৈরীর কাজ করছিলেন একজন। প্রসেসটা হাল্কা বুঝে নিচ্ছিলাম, তখনই বাড়ির কর্তা এসে হাজির হলেন।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_5

আমাদের বসার ব্যবস্থা করে আস্তে আস্তে দেখাতে শুরু করলেন তাদের কাজের নমুনা। সাথে বুঝিয়েও দিলেন, ছাঁচ তৈরী থেকে শুরু করে মূর্তি বানানোর সবকটা ধাপই (যদিও সত্যি বলতে কি, পুরোটা বুঝতে পারিনি ঐটুকু সময়ে)।

একটা স্মারক সঙ্গে না নিয়ে আসার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। ছোট্ট দেখে একটা গনেশের মূর্তি ঝোলায় ভরে নিলাম নামমাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_11

ওদের কারিগরীর সবটুকু বোঝা আর চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছে থাকলেও, বেরোতেই হোল মিনিট কুড়ি পরে। কুলিয়ানা ছেড়ে আমাদের রাস্তা চলল বাংড়িপোশির দিকে, পলাশ-শিমূল আর পাহাড়ের গা বেয়ে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_12

নির্জন প্রকৃতির কোলে আর গ্রাম্য সরলতার মাঝে বাংড়িপোশিতে রাতে থাকার একটা আলাদা অনুভূতি আছে। তাই, সেটা বাদ দিলে যাকিছু দেখার, চললাম সেদিকেই – বাঁদিক নিয়ে আসানবোনির পথে। যে পথের ধারে বুড়িবালামের মন্থর গতি মিশে গেছে হিজিলি (খড়্গপুরের হিজলি নয়) স্টেশনের একাকীত্বে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_13

সকালের আড়ষ্টতা কাটিয়ে লোকজন কেউ তখন মাছ ধরতে ব্যস্ত, …

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_14

… কেউ বা কাপড় কাচতে। তাদের সাথে সাথে বুড়িবালামের জলে ছায়া পড়েছে দূরের পাহাড়েরও।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_15

নদী ছাড়িয়ে আরও ঘন্টাখানেক যাবার পর বিসোই হাট। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছিলো বলে মাঝপথেই একটা ধাবায় দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম। ভাত, ডাল, ডিমের ভুজিয়া আর ফুলকপির ঝোল দিয়ে কোনরকমে (কারণ, রান্না খুব একটা ভালো ছিলনা) লাঞ্চ সেরে চললাম বিসোই হাটে কেনাকাটা সারতে (যদিও কি কিনবো তখনও ঠিক করিনি)।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_16

কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে যা পেলাম তা একেবারেই শহুরে একখানা মেলা। কাজেই সেখানে সময় নষ্ট না করে এগোতে থাকলাম। এই ট্রিপে দেখছিলাম, রাস্তা তৈরীর কাজ চলছে প্রায় সব জায়গাতেই (বোধহয় সামনে ভোট বলেই)। সেইমত বাঁক নিতে গিয়ে দেরী হচ্ছেও খানিকটা; তবে আমরা আগাগোড়াই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্ল্যানমতই চলেছি।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_18

পরের স্পট: সুলাইপত ড্যাম। প্রায়-জনহীন প্রান্তরের মাঝে যখন আমরা হাজির হলাম, ড্যামের জলে তখন শুধু বক আর জেলেদের আনাগোনা।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_19

পশ্চিমী ঝঞ্ঝার জন্যে নিম্নচাপ তৈরী হয়ে সপ্তাহটা মেঘলা করে না দিলে, এই মার্চের দুপুরেও মাঠের মাঝে গরমে চাঁদি ফাটার জোগাড় হত।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_20

আর এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম জশিপুর। আমাদের বুক করা হোটেলে ব্যাগগুলো গচ্ছিত রেখে ঝাড়া হাত-পা হয়ে বেরোলাম শেষ ২টো স্পট ঘুরে নিতে। বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে যাবে বলে প্রথমেই রওনা হলাম রামতীর্থ কুমীর প্রকল্প-এর উদ্দেশ্যে। মাথাপিছু ৫ টাকার এন্ট্রি টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম শিগগিরিই।  

কুমীরের ডিম-পাড়া, পালন থেকে শুরু করে তাদের সংরক্ষণের সবকটা ধাপই দেখতে পেলাম এই প্রকল্পে।

তবে এসবের থেকেও যা মনে বেশি ধরলো, তা হল: পাশেই বয়ে যাওয়া ভন্ডন নদীর পাহাড় ভেঙ্গে এগিয়ে চলা।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_26
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_27

কিন্তু সন্ধে নেমে আসছে দেখে বেরিয়েই পড়তে হলো আমাদের শেষ গন্তব্য: কিচকেশ্বরী মন্দির দেখতে। ঘন্টাখানেকের পথ পেরিয়ে খিচিং এ যখন ঢুকলাম, ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজে। ২০ টাকার পার্কিং টিকিট কেটে পৌঁছোলাম কালো গ্রানাইটে তৈরী ১১০০ বছরের পুরোন মন্দিরে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_29

তবুও, ময়ূরভঞ্জের শাসকদের ইষ্টদেবতার মন্দির বলেই হয়ত নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ পেয়ে সময়ের ছাপ পড়েনি মন্দিরের ওপর।

একটু চা-বিস্কুট খেয়ে এবার ফিরে চললাম জশিপুর। একটা করে এগরোল খেয়ে আর রাতের জন্যে রুটি-তড়কার অর্ডার দিয়ে এলাম হোটেলে। চান সেরে রুমে একটু গড়িয়ে নিতে নিতেই সময় হয়ে গেল ডিনারের। রাতের খাবার খেয়ে তাই ঘুমিয়েই পড়লাম সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে আবার পরের দিনের জন্য রেডি হতে। 

২য় দিন:

সকাল ৬টা বলা ছিল সবাইকে। সবাই সেইমত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে আগেই সেরে নিলাম ব্রেকফাস্ট: ইডলি-ঘুগনি দিয়ে। এরকম অদ্ভুত কম্বিনেশন শুনে ভুরু কুঁচকে লাভ নেই – যস্মিন দেশে যদাচার! এরপর যাওয়া হল জশিপুরের পার্মিট অফিসে।

এন্ট্রির জন্য মাথাপিছু ১০০ টাকা, ক্যামেরাপিছু ৫০ টাকা, গাড়িপিছু ২০০ টাকা আর নিরামিষ লাঞ্চের জন্য মাথাপিছু ১০০ টাকা মিটিয়ে রওনা হলাম কালিয়ানি গেট। রাস্তায় সদ্য ওঠা সূর্যের লালচে আলোয় তখন সবকিছুই বড় মায়াবী লাগছিলো।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_38

কালিয়ানি গেট ঢোকার একটু আগেই একটা পোস্টারে ওল্কুদার ফলস লেখা দেখে আমরা ডানদিকে বাঁক নিলাম। এদিক ওদিক জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছেও গেলাম ওল্কুদার গ্রামে। কিন্তু স্থানীয় কুকুররা গ্রামের মুখ থেকেই আমাদের তাড়িয়ে দেবার পক্ষে রায় দিলো। গ্রামেরই মাঝবয়সী পূর্ণ নায়েক বাদ সেধে আমাদের রাস্তা না দেখালে আমাদের হয়ত গতিপথ পরিবর্তন করতেই হত।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_39

কাঠ কাটতে বেরোচ্ছিলেনই; কিন্তু আমাদের অসহায় দেখেই কুড়ুল হাতেই এগিয়ে এলেন পূর্ণদা। পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে চললেন আমাদের গ্রাম থেকে মাঠে, দিগন্ত যেখানে পাহাড় ছুঁয়েছে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_40
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_41

মাঠের শেষে রাস্তা ঢুকলো জঙ্গলে, যেখানে বিরল হলেও দেখা পাওয়া যেতেই পারে বাঘ, ভালুক বা হাতির। অন্তত নায়েকদার অভিজ্ঞতা সেরকমই। সেরকম অভিজ্ঞতা হওয়া ভালো না খারাপ বুঝে উঠতে পারলাম না, বরং এগিয়েই চললাম।

আধঘন্টা হাঁটার পর প্রথম দেখতে পেলাম খইরি নদীর স্রোত। নড়বড়ে নুড়ির ওপর পা রেখে রেখে সেই স্রোত পেরোতেও হল চার-পাঁচবার।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_43a

এভাবে একঘন্টার হাঁটার পর পৌঁছলাম ওল্কুদার জলপ্রপাত আর প্রথম দর্শনেই উড়িয়ে দিল এতক্ষনের সব ক্লান্তি।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_45
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_46

আমরা এতেই খুশি হলেও পূর্ণদা ছাড়ার পাত্র নয়; বলল এবার আমাদের নিয়ে যাবে জলপ্রপাতেরও ওপরে। মাটি-কাদা-শ্যাওলা ভরা পাহাড়, গুহা আর জঙ্গল টপকে আর পূর্ণদার বিশ্বাসে ভর করে কয়েকজন এগিয়ে চলল। আমি বসলাম ঝর্নার সামনেই।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_49

অর্ধেক রাস্তা পৌঁছবার পর ওদের একবার দেখতে পেলাম, ওরাও আমাকে। তারপরের রাস্তা আমার দেখা নয়; যেহেতু জঙ্গলের আড়ালে।

এই ঝর্নারও ওপরে অপেক্ষা করে ছিল আরেকটা ছোট জলপ্রপাত! পূর্ণদা তারও ওপর অবধি দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু এখানেই এতটা সময় বেরিয়ে গেলে আমাদের বারিপদায় পৌঁছনো চাপ হয়ে যেতে পারে। কাজেই সবাই শুরু করল নীচে নামা …

… আর ফিরে আসা।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_54
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_55
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_56

ঝর্না দেখে যখন গ্রামে ফিরে এলাম, দশটা বেজে গেছে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_57

পূর্ণদা আমাদের ছেড়ে গেলেন গাড়ী অবধি। সাধ্যমত সামান্য কয়েকটা টাকা পূর্ণদাকে দিলাম, যদি ওনার কাজের যে ক্ষতি করলাম তার খানিকটা মেটে এই ভেবে। ওল্কুদার থেকে দশ মিনিটে পৌছলাম কালিয়ানি গেট আর পার্মিট দেখিয়ে, এন্ট্রি করিয়ে শুরু করলাম সিমলিপাল ন্যাশনাল পার্কের সাফারি।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_37

সামনেই কালিকাপ্রসাদ গেটে আবার এন্ট্রি হল, সাথে ব্যাগ-চেকিংও।

পুরো রিজার্ভটা জুড়েই রয়েছে অনেকগুলো চক, যেখানে গ্রামবাসীরা থাকে। চারপাশে গবাদিপশুরও ঘোরাফেরা অবাধ আর গ্রামবাসীরাও সাইকেল বা বাইকে যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাতে আমাদের বন্য জন্তু দেখতে পাবার আশা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকলো।

তবে বন্য জন্তু না পেলেও যে স্পটগুলো স্পট করতেই পারবো, তা হল এখানকার তিনখানা ঝর্না: উস্কি, বহেরিপানি আর জোরান্দা।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_62a

প্রথমেই দেখা পেলাম উস্কি জলপ্রপাত-এর গাড়ী থেকে নেমে মিনিট পাঁচেকের রাস্তায়।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_63
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_64

উস্কির পর পেরিয়ে চললাম গ্রামের পর গ্রাম।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_66
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_67

শেষমেশ বহেরিপানি গ্রাম এসে পৌছলাম। একটা বেজে গেছিল বলে আগেই সেরে নিলাম লাঞ্চ। স্থানীয় গ্রামবাসীদের ব্যবস্থাপনায় চলা জঙ্গলের মাঝে এই নিরামিষ ক্যান্টিনটার খাবার খেয়ে বেশ অবাক হলাম। যেমন রান্না, তেমনই ভালো আয়োজন।

লাঞ্চের পরে রওনা দিলাম: চ্বাহাল ওয়াচ টাওয়ার। যদি কিছু বন্য জীবজন্তু দেখতে পাওয়া যায়, এই আশায়। কিন্তু আধঘন্টার অপেক্ষার পর হতাশ হয়ে চললাম …

… সিমলিপালের সবচেয়ে আকর্ষনীয় বহেরিপানি জলপ্রপাতের দিকে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_74
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_75

বহেরিপানি থেকে বেরোলাম সাড়ে চারটায়। অল্কুদার জলপ্রপাত ঘুরতে অনেকটা সময় বেরিয়ে যাওয়ায় জোরান্দা ফলসটা প্ল্যান থেকে কাটিয়ে দিতে হল। কখনও লোহার, কখনও কাঠের নড়বড়ে সেতু পার করতে করতে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এগিয়ে চললাম এক্সিট গেটের দিকে।

তবে শেষমেশ সময়মতই পিথাবাটা গেট দিয়ে বেরিয়ে সাতটার কাছাকাছি বারিপদায় ঢুকলাম। এর মধ্যেই গুগল সার্চ করে গোটাকয়েক হোটেল খুঁজে আর ফোন করে শর্টলিস্ট করে ফেলেছিলাম। তাদেরই একখানা, হোটেল সাই বিনায়ক (যোগাযোগঃ ৬৭৯২২ ৫৫৭৫০) ঘুরে দেখলাম প্রথমে। সেখানেই পছন্দসই তিনখানা রুম (২টো ডাবল আর একটা ট্রিপল বেডেড) বুক করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ডিনারের ব্যবস্থা করতে। সারাদিনের সাফারিতে ক্লান্ত ছিলাম বলে একটু তাড়াতাড়িই চিকেন বিরিয়ানি দিয়ে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এলাম।

৩য় দিন:

খুব বেশি ঘোরার ব্যাপার না থাকায় এদিন সকালে আয়েস করে উঠলাম প্রায় আটটার দিকে। চানটান করে হাজির হলাম দিনের প্রথম স্পট – ময়ূরভঞ্জ প্যালেস-এ। ইন্টারনেট বলেছিল, এটা রাজবাড়ি যেটা সম্প্রতি মিউজিয়াম হয়েছে। কিন্তু পৌঁছে জানলাম, মিউজিয়াম নয়, হয়েছে কলেজ! আর, তাও সেদিন শিবরাত্রি বলে বন্ধ।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_78

ময়ূরভঞ্জ প্যালেসের গেটের বাইরেই একটা দোকানে চা খেয়ে তারপর গেলাম শ্রীশ্রীজগন্নাথ মন্দির

বারিপদায় আর তেমন কিছু দেখবার নেই, তাই এবার ফেরার পথে পা বাড়ালাম; কিন্তু একটু ঘুরে ঘুরে। উড়িষ্যা থেকে ঝাড়গ্রাম জেলা দিয়ে ঢুকলাম নিজের রাজ্যে। প্রথমেই যাবার কথা দেউলবারের রামেশ্বরম মন্দির। কিন্তু শর্টকাট নিতে গিয়ে পড়লাম একটা ডেড-এন্ডে যেখানকার লোকজন (এমনকি তাদের পোষা গোরু-ছাগলও) অবাক হয়ে দেখতে থাকলো আমাদের।

পরের রাস্তাটা ধরে অবশ্য একেবারেই পৌঁছে গেলাম রামেশ্বরম মন্দিরে; এদিকে সেখানে তখন পুরোদস্তুর মেলা লেগে গেছে; সবখানেই শুধু রঙের ছড়াছড়ি।

আর মেলার সুযোগে ফাঁকা মাঠে রাখার জন্যেও ৩০ টাকা পার্কিং চার্জ দিয়ে আমরা মন্দির দর্শনে গেলাম।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_86
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_87

দেউলবারের মেলার জন্য রাস্তা এদিক ওদিক বন্ধ করায় জিজ্ঞেস করে করে যেতে হল আমাদের পরের গন্তব্য: তপোবন

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_88
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_89

সেখান থেকে বেরিয়ে আবার উড়িষ্যা যাবার পালা।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_92
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_93

গুগল ম্যাপ পথ দেখাতে না পারায় সেই জিজ্ঞেস করে করেই পৌঁছতে হল রাইবোনিয়া গড়। সেখানকার মন্দিরেও সেদিন নেমেছে মানুষের ঢল।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_94a

কালাপাহাড়ের হাতে বিধ্বস্ত বলে পরিচিত হলেও …

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_95
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_96

… ৭০০ বছরের পুরোন গড়ের স্থাপত্যের ওপর স্থানীয়দের যথেষ্টই ভরসা আছে দেখে ভালো লাগলো। যতই হোক ASI এর সংরক্ষণ বলে কথা!

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_97

গড় থেকে গড়গড় করে বেরিয়ে এসেই পড়লাম সুবর্ণরেখায়।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_100a

সেখানে নদীর অবস্থা করুণ, নদীর ৮০ শতাংশই বালি। বাকিটাও ঘিরে তার ওপর মোরাম ফেলে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে স্থানীয়রা। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হল গুগল বলছে, আমরা নদীর ওপর। ম্যাপেও দেখাচ্ছে নীল, কিন্তু আমরা মোরামের রাস্তায়।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_101

তবে বছরে এক-দু মাস বর্ষার সময় পুরো নদীতেই জল থাকে। বর্ষা চলে গেলে আবার করতে হয় রাস্তা তৈরীর কাজ। যাই হোক, এমন নদী (বা বালিয়াড়ি) পেয়ে আমরা বেশ কেত মেরে কিছু ছবি তুলে নিলাম।

বাংলায় ঢুকেই খোঁজ পড়ল দুপুরের খাবারের জন্য হোটেলের। দাঁতনের কাছে একটা হোটেলে চিকেন মিল দিয়ে লাঞ্চ সেরে যখন বেরোব ভাবছি, তখন মেঘের মুখ ভার। মেঘের হাঁড়িমুখে মোঘলমারী! ৬০০ থেকে ১২০০ শতাব্দীতে তৈরী বৌদ্ধমহাবিহারে এসে পৌঁছলাম ৩টের দিকে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_104

মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ, পুরোন আমলের স্টাকোর কাজকর্ম আর মিউজিয়ামে রাখা কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন দেখতে দেখতে মেঘ অনেকটাই কেটে গেল।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_105
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_106
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_107

নিশ্চিন্ত হয়ে তাই আমরা চললাম কুরুম্ভেরা দুর্গ। কেশিয়াড়ীর কাছে গগনেশ্বরের এই দুর্গ আগে উড়িষ্যার অংশ ছিল; এর স্থাপত্যশৈলীতেও তার নমুলা মেলে।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_111
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_112
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_113

পরে ঔরঙ্গজেবের আমলে দুর্গের মন্দির পরিবর্তন করে মসজিদ তৈরী করা হয় বলে অনেকে অনুমান করেন, অবশ্য এর সত্যতা যাচাই করা অসম্ভব।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_114
simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_116

দুর্গ থেকে বেরিয়ে তারপর আমরা চললাম সিনেমার পাতায়। মনোজদের অদ্ভুত বাড়িতে: হাঁদলা গ্রামের রাজবাড়ি, যা “হাঁদলা রাজগড় নারায়ণগড়” নামেও পরিচিত।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_117

অনুমতি নিয়ে একটু চারপাশ ঘুরে দেখলাম, আলাপও হল পরিবারের লোকজনদের সাথে যারা এখনও থাকেন ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ির খানিকটা অংশ সারিয়ে টারিয়ে।

তবে খারাপ লাগলো বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠাকুরবাড়িটা দেখে। অবস্থা যথেষ্ট ভালো হলেও অজ্ঞাত কারণে জঙ্গল গ্রাস করছে কোন এক সময়ের গৌরবের নিদর্শনটুকু।

simlipal_upperberth_krishnendu_ghosh_123

হাঁদলা থেকে এবার রওনা হলাম আমাদের ট্রিপের শেষ গন্তব্যের দিকে: খালের বনপাতনা গ্রাম। উদ্দেশ্য রঘুনাথজিউ মন্দির দর্শন। গিয়ে জানতে পারলাম, শুধু সকালে পূজোর সময়ই মন্দির দিনে একবার খোলা হয়।

তবে পাঁচিল খুব একটা উঁচু না হওয়ায়, মন্দিরের বাইরেটুকু দেখে নিতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি।

বনপাতনা থেকে বেরিয়ে খড়্গপুরে এসে পৌঁছতেই শেষ হল আমাদের তিন দিনের ছোট্ট ট্রিপ।