Chandaka

ওড়িশায় আমার তৃতীয় মাসের প্রথম মঙ্গলবারই, শিবরাত্রির ছুটি। তাই রাজেশকে বললাম, “চ, ছন্দক টা ঘুরে আসি। তুই সাইটে গিয়ে দেখে নে, সকালে সাফারি হবে কিনা।” ও দেখে টেখে বলল, “অনলাইনে অ্যাভেলেবেল দেখাচ্ছে।” সকাল ৭টার সাফারিটা করব ভেবে, আমরা প্ল্যান করলাম ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ার।

ছন্দক বলতে, ভুবনেশ্বরের ছন্দক এলিফ্যান্ট স্যাংচুয়ারি। ছন্দক সামান্য আয়তনের জঙ্গল; তাতে হাতিই বলুন বা অন্যান্য জীবজন্তু, তেমন বেশী কিছুই নেই। তবে শোনা কথা, শীতকালে পাখিদের ভিড় হয়; মূলত উত্তরের আরাচন্ডী জলাটার জন্য। ওড়িশার জঙ্গল বলতে, এর আগে খড়গপুর থেকে সিমলিপাল ঘুরে গেছি একবার। সিমলিপাল ঘোরার সেই অভিজ্ঞতা সুন্দর হলেও, বন্য জীবজন্তু কিছুই চোখে পড়েনি। তাই, ছন্দক নিয়েও আমাদের খুব বেশী কোন প্রত্যাশা ছিলনা।

মঙ্গলবার আমরা বেরোলাম সকাল ৬টার দিকে। কলেজের সামনের মোড়ে এসে আগে চা অর্ডার করলাম; তারপর, Ola থেকে একটা অটো। চা শেষ করে, সামান্য ঠান্ডা আর কুয়াশা ঘেরা রাস্তা দিয়ে আমাদের অটো চলল ছন্দক।

ঝাঁ চকচকে রাস্তা দিয়ে ছন্দকে এসে পৌঁছলাম এক ঘন্টায়। হাইওয়ে লাগোয়া স্যাংচুয়ারিতে তখনও মাঝরাত; কাউন্টার বন্ধ, কোনও সিকিউরিটি নেই।

নিজেরাই স্লাইডিং দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। সামনে ছন্দক স্যাংচুয়ারির পেল্লাই গেট। গেটের পরেই ফুট তিনেকের একটা পরিখা, যেটা বাকি জায়গার থেকে স্যাংচুয়ারিকে আলাদা করে রেখেছে। গেটের বাঁপাশে রাখা আছে সাফারির গাড়ীগুলো আর ডানদিকে গেস্ট হাউস – গোদিবারি ন্যাচার ক্যাম্প। কিন্তু, কোথাও কোনও লোকজন চোখে পড়ল না – না কোনও ট্যুরিস্ট, না স্যাংচুয়ারির কোনও কর্মচারী।

ন্যাচার ক্যাম্পের ঘরগুলোর সামনে গিয়ে জোরে হাঁকাহাঁকি করাতে শেষে একজন এসে হাজির হল। তার কাছেই মাথাপিছু ৪০ টাকা আর ক্যামেরা পিছু ৫০ টাকা করে এন্ট্রিফি জমা করলাম। সে জানাল, গেস্ট হাউসে কোনও গেস্ট নেই। কেউ সাফারিও বুক করেনি। আর, কুয়াশার জন্যে আমাদের সাফারিতে যেতে যেতে কম করে আটটা বাজবে। ততক্ষণ আশপাশটা ঘুরে দেখে নেবার সুযোগ আছে। পাশে শেকলে বাঁধা দুটো হাতি দেখে আমরা তাই, পায়ে হেঁটেই ঢুকলাম স্যাংচুয়ারিতে।

স্যাংচুয়ারির গেটের পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলো একদল বাঁদর; আমাদের দেখে তারা গা ঢাকা দিল গাছের আড়ালে।

স্যাংচুয়ারিতে ঢুকতেই রাস্তার দুদিকে ছোট্ট দুখানা পুকুর। কুয়াশায় জঙ্গলের মধ্যে দশ-বিশ ফুট দূরের কোনকিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে এই কুয়াশাটা আছে বলেই, আমাদের জঙ্গলে ঘোরাটা খানিকটা রোমাঞ্চকর হল।

লাল মোরামের রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। কুয়াশার জন্যে চোখে না পড়লেও, কানে আসছে অনেক রকম পাখির ডাক।

চারপাশের বেশীর ভাগ গাছই চেনাশোনা – বেশীর ভাগই শাল, সেগুন, জারুল ইত্যাদি। অচেনাগুলোর হদিশ পাওয়া গেল রাজেশের মোবাইলের একটা অ্যাপ (PlantNet) থেকে।

সামনে থেকে রাস্তা দুভাগে ভেঙ্গেছে; বাঁদিকের রাস্তাটা গেছে ঝুমকা ড্যামের দিকে আর, ডানদিকেরটা সোজা জঙ্গলের মাঝখান হয়ে দামপাড়ার দিকে। আমরা বাঁদিক দিয়ে ড্যামের দিকে এগোতে থাকলাম।

কিন্তু, ড্যামে যাবার রাস্তা স্যাংচুয়ারির সাথে জোড়া নয়। ড্যামের পাশ থেকে আমাদের ফিরে আসতে হল, সাফারির জন্য। কিন্তু ফিরে দেখি, তখনও কারোও কোনও পাত্তা নেই। আমরা খানিকক্ষণ গেস্ট হাউসের চারপাশে ঘুরে বেড়ালাম। সেখানে একদিকে গেস্টদের জন্য করা আছে, সামান্য অ্যাডভেঞ্চার রাইডের ব্যবস্থা।

আর অন্যদিকে রয়েছে ছাউনি করে অল্প বসার জায়গা আর বাচ্চাদের জন্য স্লিপ, দোলনা। আছে ছোট্ট একটা ফুলের বাগানও।

৮টাও যখন পার হয়ে গেল, আমরা আরেকবার সাফারির সময় জানতে গেলাম অফিসে। কিন্তু, কুয়াশা না কমায় সেই সময় আবার পিছিয়ে হল, ৯টা। ঘন্টা দেড়েক হেঁটে আমাদের ততক্ষণে বেশ খিদে পেয়ে গেছিলো। কিন্তু, খাবার ব্যবস্থাও আছে কান্তাবাড়ায়, যা স্যাংচুয়ারি থেকে মিনিট কুড়ির রাস্তা। সাফারির মায়া কাটিয়ে, আমরা স্যাংচুয়ারি থেকে বেরিয়ে …

… একটা অটো ধরে কান্তাবাড়া এলাম। এই মোড়ে একখানাই খাবার হোটেল। সেখানেই আমরা ব্রেকফাস্ট সারলাম লুচি, ঘুগনি, সম্বর বড়া, আর রসগোল্লা দিয়ে। দোকানটা দেখতে তেমন পদের না মনে হলেও, খাবার-টাবার বানিয়েছিল যেমন ভালো, আর দামও নিল তেমন সস্তা।

সাফারি ছাড়া ছন্দকে ঘোরার জায়গা বলতে, দুটো ড্যাম – ডেরাস আর ঝুমকা। কাজেই, ব্রেকফাস্টের পর আমাদের গন্তব্য হল, ডেরাস ড্যাম। কান্তাবাড়া থেকে ডেরাস ড্যাম যাবার জন্য অটো পাওয়া যায়। কিন্তু, ব্রেকফাস্টটা হজম করার জন্য আমরা হেঁটেই রওনা হলাম ডেরাস ড্যাম। যাওয়া-আসা মিলিয়ে মোট ৭কিমি রাস্তা – গ্রামের মাঝখান দিয়ে।

রোদের মধ্যে দিয়ে আমরা রাস্তা হেঁটে চলেছি। রাস্তার ধারে কখনও চোখে পড়ল, প্রাকৃতিক ভাবে খয়ে যাওয়া ডোবা যা প্রথমবার দেখলে মনেই হবে, কোনও ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ …

… কখনও, চাষের জমি। তবে, চাষবাষ যা হচ্ছে, তা মূলত ড্যামের কাছাকাছিই। ড্যামের জল মাটি কেটে না আনলে, এখানকার লাল মাটিতে চাষ করা মুখের কথা নয়।

স্যাংচুয়ারির এন্ট্রিপাশ দেখিয়েই ঢুকলাম ডেরাস ড্যাম। ড্যামের জলে ব্যবস্থা আছে বোটিং-এর (৯জনের আধঘন্টা বোটিং-এর ভাড়া ৯০০টাকা)।

ড্যামের পাড় দিয়ে হেঁটে, আমরা এরপর এগোলাম ড্যামের অন্যদিকটায়, যেদিক থেকে জলে নামা যাবে।

ড্যামের বাঁদিকে এসে আমরা গাছের তলায় আমাদের ব্যাগগুলো রেখে, চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। আমাদের পিছু নিল একটা কুকুর।

ফিরে এসে, গাছে ছায়ায় আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম। হাটাহাটির ধকলটা কাটিয়ে নিয়ে …

… ডেরাস ড্যাম থেকে আমরা ফিরে চললাম কান্তাবাড়ার দিকে।

ড্যাম থেকে বেরিয়ে এসে, সামনের একটা দোকানে গেলাম চায়ের খোঁজে। কিন্তু, চা পাওয়া গেলনা। শুধু মিনারেল ওয়াটার দিয়ে কাজ চালাতে হল। আবার, একঘন্টা হেঁটে এসে পৌঁছলাম কান্তাবাড়া। মোড়ের মাথায় একটু চা খেয়ে আর বিশ্রাম নিয়ে জুড়োলাম হাটার ক্লান্তি। এরপর, আমরা চললাম ঝুমকা ড্যাম। অটোয় চেপে ঝুমকা ড্যাম পৌছতে লাগলো মিনিট দশেক।

শিবরাত্রির ছুটি বলে, ড্যামের আশেপাশে সেদিন ছোটখাটো ফিস্টের আয়োজন করেছে স্থানীয়রা। ড্যাম থেকে কান্তাবাড়াতে ফিরে আসতেই, সেদিনকার মত আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ হল। লাঞ্চের সময়ও হয়ে গেছিল, তাই দেরী না করে আমরা বাড়ীর পথে পা বাড়ালাম।

.

.

.