Bolpur

পৌষের মাঝামাঝি, উঠল দুলে মন। চল অকাতরে সবাই, শান্তিনিকেতন।

এরকমই নিশ্চয় কোনও কবিতা আছে! নাহলে, পৌষ আসতে আসতেই সবার কেন বোলপুর যাবার বাই উঠে যায়, বলা কঠিন। পৌষমেলার সময়টা ভিড় হবার আগে একটা কারণ ছিল; সেটা বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়াতে কি তফাত হয়েছে জানিনা! কিন্তু যখন ক্যাম্পাসও বন্ধ আর পৌষমেলাও শেষ; তখনও যে বোলপুরে ঠাসা ভিড় হতে পারে – সেই ব্যাপারে আমার তেমন ধারণা ছিলনা। ধারণা হল, যখন ট্রেন আর হোটেল বুক করতে গেলাম ডিসেম্বরের শুরুতে। দেখি, মাস-দুয়েকের মধ্যে শনিবার-রোববার মানেই ট্রেনে টিকিট নেই। সস্তা অথচ ভালো হোটেলগুলোরও অবস্থা সেই একই। তারই মধ্যে, যেগুলো বেঁচে আছে – তাদের দাবিদাওয়া অদ্ভুত! অন্তত দুইদিনের বুকিং করতেই হবে। তবুও এদিক-ওদিক ঘেঁটে ব্যবস্থা করা হল ট্রেন আর হোটেলের – ইংরাজী নতুন বর্ষবরণের দিনে।

৩১শে ডিসেম্বর, শনিবার:

সকালের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে, আমরা তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। সকাল ৬টায় দক্ষিণেশ্বর থেকে শিয়ালদার একটা ট্রেন থাকার কথা – যদি ধরতে পারা যায়! অটো বা রিক্সা না পাওয়ায়, হেঁটে দক্ষিণেশ্বর যেতে বেজে গেল সওয়া ৬টা। পরের ট্রেন শিয়ালদায় যখন ঢুকবে, আমাদের মাতারা এক্সপ্রেস শিয়ালদা থেকে ছাড়ার কথা তখনই। বাড়তি ঝুঁকি না নিয়ে, দক্ষিণেশ্বর থেকে একটা হলুদ ট্যাক্সিতে চেপে চললাম শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে মাতারা এক্সপ্রেস ছাড়ল ৭টা ২০তে, একেবারে কাঁটায় কাঁটায়।

আমাদের ট্রেনের টিকিট যদিও বোলপুর-শান্তিনিকেতন অবধি, কিন্তু আমাদের হোটেলটা ‘প্রান্তিক’ স্টেশনের কাছে। তাই, আমাদের যাত্রার প্রান্তিক স্টেশন হল ‘প্রান্তিক’ই, ঢুকলাম সাড়ে ১০টা নাগাদ।

খাবার বা থাকার হোটেল বলুন, ঘোরার জন্য গাড়ি বলুন – এসবের হদিশ পাবার সেরা ঠিকানা স্টেশন-চত্বরই। প্রান্তিক থেকে ঘোরার জন্য একটা টোটো বুক করে আমরা চললাম আমাদের শান্তিনিকেতন হোমস্টে। মূল শান্তিনিকেতনের উল্টোদিকে, গ্রামের মধ্যে একটা সদ্য তৈরী একটা হোটেল – যার সব আনুষঙ্গিক তখনও জোগাড় করা হয়ে ওঠেনি। সেই কারণেই, শান্তিনিকেতন হোমস্টে বুক করা গেছিল অত দেরী করেও। হোটেলটা তেমন ভালো না হলেও, মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন আর নির্ঝঞ্ঝাট; আমাদের বাজেট আর দাবীর তুলনায় জুতসই।

আমাদের বেরোনোর তাড়া ছিল। তড়িঘড়ি চান সেরে, সেই টোটোটাতেই চেপে ঘোরা শুরু করলাম। প্রথমেই চললাম, বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের দিকে।

কোভিডের ঢেউ মিলিয়ে গেছে অনেকদিন। কিন্তু পৌষমেলায় বাইরের লোকজনের অযথা হুজুক-হুজ্জুতি সামাল দিতে না পেরে বিশ্বভারতী তাদের ক্যাম্পাস বন্ধই রেখে দিয়েছে। অন্যান্য দেশে সম্প্রতি কোভিডের ঢেউ আবার অল্প মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও, আমাদের দেশের লোকজন সচেতনভাবে কোভিডকে কোনরকম তোয়াক্কা না করেই চলেছে। তাই, ২০২৩শের শুরুতেও বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে চীনের প্রাচীর। চিড়িয়াখানার মত খাঁচার ওপার থেকে দেখে নিতে হবে পুরোটাই।

ক্যাম্পাসের দ্রষ্টব্যগুলো মাওরা দেখে নিলাম একের পর এক – প্রথমেই তিন পাহাড়

ঘুরতে আসা লোকজনদের সাথে ক্যাম্পাস পাল্লা না দিতে পারলেও, দেদার সঙ্গ বিলোচ্ছে দোকানদারেরা – তাদের ভ্যান উপচে পড়ছে রকমারি জিনিসে। সবই হাতের নাগালে, বাজেটের ভেতরে, আর মনের মতন।

তারপর, আমরা দেখলাম, বাচ্চাদের স্কুল, …

উপাসনা গৃহ (কাঁচ মন্দির), …

মূল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, …

ছাতিম তলা, …

আর, নন্দন আর্ট মিউজিয়াম

ক্যাম্পাসের সামনে তখন তুমুল ভিড়। তার মাঝে, একজন দইওয়ালা সাইকেলে করে দই আর রাবড়ি বিক্রি করছে। লোকজন ব্যস্ত মূলত সেলফি নিতে, কেউ কেউ দই খেতেও।

তাদের ভাড়া করা গাড়ি, টোটো রাস্তার ধারে লাগানো; সাথে সরু রাস্তায় চলছে যাওয়াআসার গাড়িগুলোর দু’খানা সারি। পৌষমেলা শেষ হয়ে গেছে, দু’দিন হয়ে গেছে। তবু, মানুষের উৎসাহে ভাঁটা নেই। ফলে, অল্প দূর গিয়েই সবার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। সবে মিলে, চোখের সামনে যেন বালি ব্রিজের জ্যাম!

অবস্থা দেখে আমরাও টোটো থেকে নেমে পড়লাম। হেঁটেই ঘুরলাম কলা ভবন, …

… দেখলাম বেইজ-এর স্থাপত্য, …

…, পৌঁছলাম অমর্ত্য সেনের বাড়ি, প্রতীচী। চোখে পড়ল নন্দলাল বসু, আরও অনেকের বাড়ি।

আমাদের পরের স্পট, সৃজনী শিল্পগ্রাম। মাথাপিছু ৩০টাকা এন্ট্রিফি দিয়ে, ঢুকলাম গ্রামে।

গ্রামের সামনেই পুতুল ঘর, …

… ডানদিকে একটা মাঠ, মাঠে খোলা মঞ্চ।

আর সামনে, পরের পর রাজ্যের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী সাজানো। শুরু হল, বাংলা দিয়ে।

একে একে, দেখলাম ওড়িশা, …

… ঝাড়খণ্ড, …

… মধ্যপ্রদেশ, আসাম, মণিপুর, আরও সব রাজ্যের প্রদর্শনী।

শেষে পুকুরের ধারে বসে হাল্কা জিরিয়ে নিলাম; লাঞ্চ করতে একটু দেরী হবে বলে উদরস্থ করলাম খানিক খাবার-দাবার।

শিল্পগ্রামের শেষপর্বে আছে, দোকানের পসরা।

তবে, বিকেলে সোনাঝুরির হাটে যাওয়া হবেই বলে বেকার দেরী না করে …

… চললাম আমাদের পরের গন্তব্য – সুরুলের রাজবাড়ি। প্রথমে, বড় তরফের বাড়ি।

দুর্গাদালান, তুলসীমঞ্চ ঘুরেটুরে …

… গেলাম ছোট তরফের ঘরে। সেখানে দূর্গার আটচালায় খড় দিয়ে বাঁধা হয়ে গিয়েছে মায়ের মূর্তি।

আর আছে, পোড়ামাটির কাজকরা মন্দির।

রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে চললাম দুপুরের খাওয়া সারতে – আমার কুটির-এ।

আমার কুটির বোলপুরে একটা ব্র্যান্ড। তাদের রকমারি বাঙালি খাবারের বন্দোবস্ত – শুক্তো থেকে শুরু করে পমফ্রেট বা পাঁঠা, রসগোল্লা থেকে কলমী শাকভাজা বা ভেটকির পাতুড়ি, পাওয়া যাচ্ছে সবটাই। বীভৎস একটা ভিড়ে হাতড়ে-হাতড়ে জোগাড় করলাম খাবার কুপন আর সিট। আমরা ১৫০টাকা বিনিময়ে নিলাম নিরামিষ থালা – ভাত, কলমী শাকভাজা, দুধ শুক্তো, সবজি ডাল, বেগুনী, ধোঁকার তরকারী, পায়েস, চাটনি, আর পাঁপড়।

খাওয়া সেরে, দেখতে গেলাম ৩৭ফুটের বুদ্ধ

তারপরেই, প্রকৃতি ভবন, …

… আর, সবশেষে সোনাঝুরির হাট

হাট থেকে সামান্য স্মারক কেনাকাটা করে, আমরা হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় পড়বে বলে দেখেও নিলাম, কোপাই নদী

সূর্য প্রায় ডুবেই এসেছে; কিন্তু নদীর ধারেও সেই দোকানের ভিড় আর ইতিউতি বাউলের মজলিস।

হোটেলে ঢোকার সময়ই সন্ধ্যের জন্য অল্প কিছু খাবার তুলে আনলাম। চা অর্ডার দিলাম হোটেলেই; রাতের খাবারও। সময় কাটল ব্যাগটা গুছিয়ে, ছবিটবি দেখে। ডিনার সেরে, বোলপুরের ঠাণ্ডা ঠেকাতে হোটেল থেকে অতিরিক্ত দুখানা কম্বল ধার করতে হল। তাতে, ঘুমটা হল দারুণ।

১লা জানুয়ারী, রবিবার

তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায়, ঘুম ভাঙলও সকাল-সকাল। চানটান সারার ব্যাপার নেই বলে, আমরা সাড়ে ৬টার মধ্যেই তৈরী হয়ে গেলাম। কিন্তু বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখি – বোলপুরের ঠাণ্ডা “বাতাস শুধু কানের কাছে / বহিয়া যায় হুহু।” সেই ঠাণ্ডায় ছেলেকে নিয়ে বেরোন সমীচীন নয়। বেগতিক দেখে, আমি টোটোওয়ালাকে ফোন করে খানিক পরে আসতে বললাম।

আটটার দিকে যখন কুয়াশা অনেকটাই কমে গেছে, আমরা চাপাচুপি দিয়ে চললাম কঙ্কালীতলা। বোলপুরের ওইদিকটার হাবভাব বেশ গ্রাম্য – কোথাও বউ পুকুরধারে কাপড় কাচতে বসেছে, কোথাও রাখাল ছেলেটা ছাগল-ভেড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে যেখানে “বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে / শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়েছে স্রোতে / তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো।”

আর, মাঠের মাঝে ভিড় জমিয়েছে অনেক অনেক খেজুর গাছ। স্বাভাবিক ভাবেই, গ্রামেগ্রামে দোকান চোখে পড়ছে, যেখানে তৈরি করে বিক্রি হচ্ছে লবাত আর গুড়। ৬০ থেকে শুরু করে ৩০০টাকা অবধি দামে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের গুড়।

কঙ্কালীতলা ঢুকলাম প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে।

জাগ্রত মায়ের মন্দিরে পুজো দেবার বেশ ভিড় – সঙ্গত ভাবে, ভিড় লেগেছে দোকানেরও।

আমাদের বেশীর ভাগ ঘোরাটাই আগের দিন হয়ে গিয়েছে। তাই, সেদিন সকালে “ওড়ার আনন্দে পাখি / শূন্য দিকে দিকে” অযথা সময় খরচ করে বেড়াতে থাকলো।

মন্দিরের বাইরেই আবার দেখা পেলাম, কোপাই-এর।

মন্দির থেকে যেদিকে নদী, তার উল্টোদিকের রাস্তাতেও বসেছে গাদা-গাদা দোকান। কেউ বিক্রি করছে পুতুল, কেউ আখের রস, আরও কত কি!

সে রাস্তা দিয়েই এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম, সর্ষের খেত।

অদূরে চলছে চড়ুইভাতির তোড়জোড়ও।

এরই পাশে, একটা পার্ক বা বাগানের কমপ্লেক্স; প্রবেশমূল্য ১০টাকা, যদিও সেটা নেবার জন্য জনমানব চোখে পড়ল না। অগত্যা, আমরা নিজেরাই পার্কে ঘুরে, দোলনা চেপে, বাগান আর খেতটা ঘুরে ফেললাম। অবশেষে টোটোওয়ালার ফোন পেয়ে, একটু তাড়া লাগিয়ে বেরোলাম মন্দির চত্বর থেকে।

কঙ্কালীতলা থেকে বেরিয়ে, আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের শেষ স্পট – বল্লভপুর ডিয়ার পার্ক-এ। বড়দের ৫০ আর ছোটদের মাথাপিছু ৫টাকা এন্ট্রিফি দিয়ে আমরা ঢুকলাম পার্কে।

তেমন কিছু প্রত্যাশা ছিলনা, তবে থাকলেও অপূরণ হতনা। আমি কোন ডিয়ার পার্কে এরকম শ’য়ে শ’য়ে হরিণ দেখিনি, কখনওই। উপরন্তু তখনই হরিণদের খেতে দিয়েছে বলে, অল্প খানিকটা জায়গার মধ্যেই সবক’টাকে পাওয়া গেল, এমনও হতে পারে।

ডিয়ার পার্কে আছে দু’খানা ওয়াচ টাওয়ার – একটা নিতান্তই ছোট, তবে অপরটি ঠিকঠাক আকারের। তবে, আশেপাশে দেখার তেমন কিছু নেই যে এটায় চড়ে দেখার সুবিধা হবে।

ছোট ওয়াচ টাওয়ারটার সামনে একটা অয়াকয়ারিয়াম আর পার্ক; বড় ওয়াচ টাওয়ারটা পেরিয়ে একটা বড় মাঠ। আমরা সবখানেই ছবি তুলতে তুলতে এগোলাম।

ডিয়ার পার্ক ঘোরার সাথে সাথেই আমাদের টোটোর প্যাকেজ শেষ হল। আমাদের বাড়ি ফেরার তাড়া আছে বলে, রওনা হলাম হোটেলের দিকে।

ঘুরতে যাবার জায়গা হিসেবে বোলপুরের বিশেষত্ব শান্তিনিকেতনের থেকে পাওয়া শিল্পচেতনায়, যা ছড়িয়ে আছে এখানকার হোটেলগুলোতে, রেস্টুরেন্টে, পার্কে, হাটে-বাজারে, বা সোজাভাবে বলা চলে জীবনযাত্রায়। সামান্য হ্যান্ডব্যাগ হোক বা শাড়ি, মাথার ক্লিপ কিংবা খেলনা – সবেতেই শিল্পের আঁচ। এই কারণেই, আমাদের ছোট্ট বোলপুর ট্রিপটা মনের মাঝে এমন ভাবে থেকে যাবে, যেন “ক্ষণকালের গীতি / চিরকালের স্মৃতি।”

ঘোরার শেষে, হোটেলে ফিরে এসে আমরা ব্রেকফাস্ট, চান সেরে একেবারে চেক-আউট করে বেরিয়ে পড়লাম ১১টার দিকে। তেমন তাড়া নেই বলে, হোটেলের উল্টোদিকের মাঠে পোজ দিতে দিতে, পায়ে হেঁটেই এগোলাম প্রান্তিকের দিকে।

১২টা নাগাদ, স্টেশন মোড়ের কাছে একটা হোটেলে অল্প করে লাঞ্চটা সেরে নিয়ে আমরা …

… প্রান্তিকে হাজির হলাম।

আমাদের কবিগুরু এক্সপ্রেস তখন আধ ঘণ্টা লেটে চলছে, উত্তরোত্তর যা গিয়ে দাঁড়াল দেড় ঘণ্টায়। অস্থির লোকজন সময় কাটাল বেশীরভাগই গল্প করে, আর কেউ তাস বা প্ল্যাটফর্মে ব্যাডমিন্টন খেলে। অবশেষে, ট্রেনে উঠলাম প্রায় তিনটের দিকে।

ট্রেন আরও লেটটেট করে ব্যান্ডেল ঢুকল ৬টায়; সেখান থেকে আরেকটা লোকাল ধরে বালি পৌঁছলাম আরও আধঘণ্টায়। বাড়ি ফেরার আগে, বালি ব্রিজের আসল জ্যামটা একবার দেখে নিতে হবেনা ?

.

.

.